আজকের দিনের জন্য চিন্তাটা কল্পনাপ্রসূত হলেও, নিকট ভবিষ্যতেই এরকম ঘটনা সত্য হতে যাচ্ছে। ইন্টারনেট সহ তথ্য যোগাযোগ মাধ্যমের অবারিত বিকাশের কারনে রোগীদের সচেতনতা বাড়ছে নিজেদের সমস্যার ব্যাপারে। ডাক্তারের চেম্বারে আসার আগে বা পরে সমস্যা নিয়ে গুগোল সার্চ দিয়ে নেয়া রোগীর পরিমান কম নয়। ইন্টারনেটেও রোগীদেরকে লক্ষ্য করে মেডিকেল তথ্য সংযুক্ত সাইটের অভাব নেই। এর মধ্যে সিংহভাগ সাইট মানসম্মত তথ্য প্রদান না করলেও, কিছু সাইট রোগীদেরকে বাস্তবসম্মত তথ্য প্রদান করে। এছাড়া শিক্ষিত সমাজের মাঝে ডাক্তারদের বাইরেও অনেকে এখন মেডিকেল রিসার্চ, লিটারেচার সম্পর্কে অনেক ভালভাবেই খোজ খবর রাখতে জানে, যেখানে কিনা বরং আমরা ডাক্তাররাই অনেকখানি পিছিয়ে আছি। সম্প্রতি অনেকের দ্বারে ঘুরে আসা ইনফারটিলিটির সমস্যায় ভোগান্তিতে থাকা কাপলের সাথে কথা বলে এই ধারনা আরো শক্ত হল, যে চাহিদা মানুষকে কতোখানি জ্ঞানপিপাসু করে তুলে। অদূর ভবিষ্যতে তাই আপনাকে মা কিংবা বাবার চিকিৎসা নিয়ে একটু জেনে/পড়ে শিক্ষিত হয়ে প্রশ্ন করতে আসা ছেলেমেয়ের সংখ্যা কম হবে না। তাদের হাতের ডকুমেন্ট যখন ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত লেটেস্ট আপডেটেড গাইডলাইনের আদলে হবে, তখন “Do not confuse my medical degree with google search” কথাটি বলে পার পেয়ে যাওয়া এত সহজ হয়তো হবে না।
এই কথাগুলো বলার পিছনের উদ্দেশে আসি এখন। আমাদের ডাক্তার সমাজের ইন্টারনেট ব্যবহার এখনো গুটিকয়েক সামাজিক ওয়েবসাইটে সীমাবদ্ধ। নিজেদের মেডিকেল নলেজ এবং প্রতিদিন আপডেট হতে থাকা চিকিৎসা পদ্ধতির সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারনাটা পরিবরতন করে নেয়ার জন্য ইফেক্টিভ ভাবে ইন্টারনেট বেইসড জার্নাল, এভিডেন্স বেইসড মেডিসিন এবং গাইডলাইন এসবের সংস্পর্শে আসা থেকে আমরা এখনো অনেকে পিছিয়ে আছি। পাঠ্যবইের বিকল্প নেই, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আজকে পৃথিবীতে ঠিক এই মুহূর্তে যে সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছেন, তা সত্যিকার অর্থে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড পূর্বের সূর্যের আলো! সূর্য পৃথিবীর নিকটবর্তী তাঁরা হওয়ার পরেও তাঁর আলো যেখানে সময়ের কাছে পিছিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দূরের তাঁরার কতটুকু পিছিয়ে আছে কল্পনা করে নিন। আমাদের বইপুস্তকের সীমাবদ্ধতা এখানেই, যে বর্তমানে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে বইপুস্তক গুলোর নীতিমালা ঘনঘন এডিসন পাল্টেও প্রায়শই পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়া কোন বইই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠে না ক্রমাগত বাড়তে থাকা তথ্য উপাত্তের ভিড়ে, রোগের নির্ণয় ভাল করে দিতে গিয়ে প্রায়শই চিকিৎসার অংশে পাতার টান পড়ে যায় প্রকাশকের। রোগীর চিকিৎসা একটু ভাল করে করতে গেলে মনের মাঝে যেসব প্রশ্ন আসে, বই পুস্তকের পাতায় তার উত্তর মাঝেমাঝে খুজেই পাওয়া যায়না।
মেডিকেল নলেজ এবং এভিডেন্স বেইস মেডিসিনের ঘাটতির সীমাবদ্ধতার আরেকটা বড় কারন আমাদের দেশে রিসার্চের অভাব (উদ্যোগ, দিক নির্দেশনার অভাব, রিসার্চ ফান্ডের ঘাটতি) এবং এর কারনে লোকাল এভিডেন্স বেইস গাইডলাইনের অভাব। স্বল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আমেরিকা/ইউরোপের গাইডলাইন ভিত্তিক। লোকাল কমিউনিটিতে এসব গাইডলাইন পদ্ধতি আদর্শ ভাবে অনুকরন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। গাইডলাইন দেশের চিকিৎসকরা যখন নিজেদের আদলে পরিবর্তন করে ক্লিনিকাল ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, তার ফলাফলে রোগী কতটুকু আর্থিক খরচে কতটুকু শারীরিক উন্নতি লাভ করে সেটিও সঠিক ভাবে রেকর্ড করা হয়ে উঠে না। তাই, চিকিৎসায় অসঙ্গতি নিয়ে শিক্ষিত মানুষ যদি অদূর ভবিষ্যতে প্রশ্ন তুলে, সত্যিকার অর্থেই ঠোঁটের আগায় জবাব দেয়ার মত উত্তর খুজে পাবেন না।
কিভাবে এসব সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব? এই প্রশ্নের অভিমত দিতে পারবেন জ্ঞানীগুণী শিক্ষকরা। শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি, যা হয়তো ক্লিনিকাল লাইনের চিকিৎসক / ট্রেইনিদের কিছুটা উপকারে আসবে।
আমার অনাহারি ডিপ্লোমা ট্রেনিং পিরিয়ডে অর্জনগুলোর মাঝে অন্যতম হল এভিডেন্স বেইস মেডিসিনের সাথে পরিচিত হওয়া। সহজ বাংলায় একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। আজ আপনার ওয়াইফ/বোন এর প্রেগম্নেন্সিতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়লো রুটিন চেক-আপের সময়। আপনি ডাক্তার, আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। মেটফরমিন নাকি ইন্সুলিন, কোনটা মা এবং বাচ্চার জন্য সেইফ? এই প্রশ্নের সমাধান কথায় পাবেন? একেক বইতে একেক অপিনিয়ন। কোন স্যারের কথা শুনবেন? Trust but verify নাকি হাই রিস্ক দেখে verify then trust? কোন সিদ্ধান্ত সব চাইতে সঠিক? কোনটা সব চেয়ে বৃহৎ সংখ্যক রোগীদেরকে নিয়ে ট্রায়াল করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে? ক্লিনিকাল ট্রায়ালে মা এবং বাচ্চার কমপ্লিকেসন সমুহ শুধু জন্মের পর কি শুধু ছোট সময়ের জন্য দেখেই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে? বড় সময়ে সম্ভাব্য কমপ্লিকেসন নিয়ে কোথায় কোন নিশ্চয়তা দেয়া হয়ে উঠেনি? – রোগীর চিকিৎসা খুবই সহজ, যখন রোগীকে পর ভাবা যায়। কিন্তু রোগী যখন আপন মানুষ জন হয়ে উঠে তখনই টান পড়ে নিজের জ্ঞানের ঝুলিতে। এসব অনিশ্চয়তার ঘাটতি যতটুকু পারা যায় তা পূরণের জন্যই এভিডেন্স বেইস মেডিসিনের প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা রিসার্চের আলোকে সর্বশেষ তথ্য নিয়েই এর কাজ। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য হিউম্যান ফ্যাক্টর হিসাবে আপনি চিকিৎসকতো আছেন!
বারডেমে কোর্স চলাকালীন সময়ে নিউরোলজি বিভাগে প্লেসমেন্টের সময় শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডাঃ বিকাশ ভৌমিক স্যারের মুখে সর্বপ্রথম “আপ-টু-ডেট (www.uptodate.com)” এর নাম শুনি। স্যার কোম্পানিকে ধরে বেঁধে পুরো বিভাগের জন্য আপ-টু-ডেট এক্সেসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এতটাকা দিয়ে একটা সাবস্ক্রিপ্সন, তখনো এর গুরুত্ব অনুভব করা হয়ে উঠে নাই। পরবর্তীতে এন্ডোক্রাইন বিভাগে প্লেসমেন্টের সময় একজন সিনিয়ের কাছ থেকে জানতে পারি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় “গ্লোবাল হেলথ ডেলিভারি” নামের একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে অনুন্নত দেশ সমুহে কর্মরত নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া অনুসারে কিছু ডাক্তারদের মাঝে আপ-টু-ডেট সাবস্ক্রিপ্সন প্রভাইড করে থাকে। সেটা থাকায় এপ্লাই করি। সাবস্ক্রিপ্সন পেয়েও যাই অল্প কিছুদিন পরে।
অল্প কিছুদিনের মাঝেই অনুধাবন করি, বই পুস্তকের স্ট্যান্ডার্ড কেয়ারের সাথে এখানে কতখানি পার্থক্য। ইন্টার্ন পিরিয়ডে মেডিসিন সাবজেক্টটা অনেকটাই আনসেটিস্ফায়িং মনে হতো, এর কারন ছিল চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে স্যারদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত, ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা, সর্বোপরি রোগীর অনেক সমস্যার সমাধান অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া। এভিডেন্স বেইস মেডিসিনের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমেই অনুধাবন করতে সম্ভব হলাম, একটু চাইলেই এসব অনেক প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তরের মাঝে কোনটি সবচাইতে সঠিক আর বর্তমানে গ্রহনযোগ্য সেটা খুজে বের করা অসম্ভব কিছু নয়, বরং নিজের চিকিৎসা পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করে নিতে এর বিকল্প নেই।
আপ-টু-ডেট ছাড়াও শতশত মেডিকেল ওয়েবসাইট (যেমনঃ মেডস্কেপ, ড্যাইনামেড ইত্যাদি), মেডিকেল জার্নাল, রেফারেন্স সাইট এখন ক্রমাগত এভিডেন্সস বেইস মেডিসিনের তথ্য প্রদান করে যাচ্ছে। কিছু সাইটের এক্সেস ওপেন, আবার কিছু সাইট পেইড। মেডিকেল লাইফের যে যত আগে এই পদ্ধতিকে নিজের জন্য আপন করে নিবেন, ভবিষ্যতে সেই হবে সব থেকে সুযোগ্য চিকিৎসক। গতানুগতিক ধারার বাইরে বের না হলে সময়ের সাথে সাথে নিজেই পিছিয়ে পড়তে হবে। তথ্য প্রযুক্তির সময়ে নিজেকে এর উপকারী দিক থেকে বিরত রাখা মানে নিজেরই বিপর্যয় ডেকে আনা।
সবার উপকার হয় এমন কিছু এভিডেন্স বেইসড সাইট (EVM) এবং সহজে জার্নাল এক্সেন্স করতে পারবেন এরকম সাইট শেয়ার করছি।
১) আপটুডেটঃ ওয়েবসাইটঃ www.uptodate.com আমার দৃষ্টিতে অন্যতম এভিডেন্স বেইসড সাইট। উন্নত বিশ্বের অনেক মেডিকেল ইন্সিটিউটে ট্রেইনি রেসিডেন্ট এবং চিকিৎসকের জন্য এটি নিজেরাই খরচ বহন করে দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই সুযোগ অপ্রতুল এবং এর সাবস্ক্রিপন ফি যথেষ্ট বেশি। কোর্সের রেসিডেন্ট দেখালে খরচ একটু কম পড়ে, তাও তা অনেক বেশি অনেকের জন্যই।
তাহলে কিভাবে এক্সেস করবেন?
ফ্রিঃ গ্লোবাল-হেলথ ডেলিভারি প্রজেক্ট নিয়ন্ত্রিত ভাবে অনুন্নত দেশের চিকিৎসকের মাঝে কিছু ফ্রি সাবস্ক্রিপ্সন বিতরন করে থাকে। নিচের লিঙ্কে এর বিস্তারিত পাবেন, এবং ক্রাইটেরিয়া ফিল করলে এপ্লাই করতে পারবেন।
লিঙ্কঃ https://www.globalhealthdelivery.org/uptodate/apply
পেইডঃ অনেকেই উপরের ক্রাইটেরিয়ার বাইরে পড়ে যাবেন। সেই ক্ষেত্রে পেইড সাবস্ক্রিপ্সনের বিকল্প নেই। কিছু আন্তর্জাতিক ড্রাগ/ফার্মা কোম্পানি এডুকেশন পারপাসের অংশ হিসাবে পেইড সাবস্ক্রিপ্স্ন ডাক্তারদের অথবা নির্দিষ্ট বিভাগে প্রভাইড করে থাকে। এছাড়া লাইব্রেরীতে যোগাযোগ করে অথবা নিজেরা মিলে সেটার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।
২) মেডস্কেপঃ (ওয়েবঃ medscape.com ) ফ্রিতে এই সাইট মেডিকেল ইনফরমেশনের একটি বেস্ট অপশন। তাদের CME এর পার্ট হিসাবে বিভিন্ন কোম্পানির স্পন্সরে নিজেরাই ওয়েব-CME আয়োজন করে থাকে, যা বিশেষ ভাবে হেল্পফুল।
৩) জার্নাল সার্চ ইঞ্জিন : https://www.readbyqxmd.com (এন্ডরয়েড এপঃ Read By QxMD)
এই সাইট/ এপটি মেডিকেলের যেকোনো টপিকের উপর অনেকগুলো জার্নাল সাইট ঘেঁটে রেসাল্ট প্রদান করে। এন্ড্রয়েন্ডে অনেক সময় জার্নাল এই এপের ভিতর থেকেই ডাউনলোড করে নেয়া যায় ফ্রি একসেস জার্নাল হলে।
৪) সাই-হাবঃ (ওয়েবঃ Sci-hub.tw ) বিজ্ঞান এবং ইনফরমেশন কখনো টাকার জন্য সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আটকা পড়ে থাকবে না, এই Motto নিয়ে একজন হ্যাকারের ওয়েবসাইট এটি। এতে প্রায় সকল পেইড জার্নালের পাব-মেড আইডি অথবা DOI লিঙ্ক দিয়ে সার্চ দিলে জার্নালের ফুল ভার্সন চলে আসে। যদিও বিষয়টি লিগ্যাল দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ, তবুও আমাদের দেশের মতো জায়গায় এটি হল মেডিকেল জার্নালের নীলক্ষেত।
৫) বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনঃ (ওয়েবঃ https://www.banglajol.info ) বাংলাদেশের ১৪২টি সায়ান্টিফিক জার্নাল নিয়ে আমাদের আছে, বাংলাজল। অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ, মেডিসিন সোসাইটি, বিএসএমএমইউ এর জার্নালের অনলাইন পিডিএফ কপি সহজেই পাবেন এইখানে।
লিস্ট আর বড় করছি না। এর কারন, যারা আগ্রহী তাঁরা নিজে থেকেই একের পর এক আপডেট থাকার ওয়েবসাইট সময়ে সময়ে আবিষ্কার করে যাবেন। হয়তো একসময় উন্নত দেশের মতো মেডিকেল এডুকেসনে বই এর পাশাপাশি এসব জার্নাল পড়া এবং শেয়ারিং করার প্রবণতা একসময় বাড়বে। কিন্তু, এতোদিনে যেটুকু আমরা পিছিয়ে গেছি, তার ঘাটতি পুরন করার সময় এখনই।