প্রথমবর্ষের
ফিজিওলজি থেকে শুরু করে মেডিকেল লাইফে যতদিন থাকা, ততদিনই সম্ভবত ঘুরে
ফিরে বারবার “ডায়বেটিস” শব্দটির মুখোমুখি হওয়া। কখনো পরীক্ষার হলে, কখনো
পরিবারের লোকজনের কাছে কখনো রোগীর কাছে। এমনকি মেডিকেল স্টুডেন্ট/ডাক্তার
না হলেও প্রতিনিয়ত পরিবার আর সমাজের এই শব্দের মুখোমুখি হওয়া। এতোকিছুর
পরেও এই পরিচিত মুখটিকে নিয়ে কিছু অজ্ঞতা থেকেই যায়।
গত দুই মাসের ডায়বেটিক হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে নিজের অজ্ঞতাগুলো নতুন করে আবিষ্কার করলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু জিনিস শেয়ার করা।
>> আমার রোগীর কয়েকদিন আগে প্রথমবার ডায়বেটিস ধরা পড়লো। রোগী কি কখনো ভালো হবে??
>> অনেক বছর আগে ডায়বেটিস ধরা পড়ছিলো ডাক্তারসাহেব, এরপর ভালো হয়ে গেছি।
>> রিপোর্টে তো ডায়বেটিস নাই ডাক্তারসাহেব, তারপরেও ডায়বেটিসের ঔষধ দিলো কেন?
>> ইনসুলিনের বদলে মুখে খাবার ঔষধ দেন তো স্যার, ইনসুলিন নিতে ভালো লাগে না।
>> ডাক্তারসাহেব, আমার ওজনতো এতো বেশী না। তাহলে ডায়বেটিস কিভাবে হল?
এরকম বেশ কিছু প্রশ্ন প্রতিনিয়ত রোগী এবং রোগীর লোকজনের মুখ থেকে শুনতে
পাই। অন্য কোন রোগের ব্যাপারে মানুষ এতো প্রশ্ন জানতে চায় না, যতটা না এই
রোগ নিয়ে জানতে চায়। ডায়বেটিস নিয়ে বিপুল জনসচেতনতাই এতো প্রশ্ন সৃষ্টির
কারন।
>> রোগী কি ভালো হবে? / অনেক বছর আগে ডায়বেটিস ধরা পড়ছিলো ডাক্তারসাহেব, এরপর ভালো হয়ে গিয়েছিলাম?
> ডায়বেটিসকে এখনো পর্যন্ত বলা হয় অনিরাময়যোগ্য রোগ। টাইপ-১ ডায়বেটিস,
যেটা কিনা পেনক্রিয়াসের সেল ড্যামেজ থেকে হয়ে থাকে, সেটি পেনক্রিয়াস
ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট অপারেশন করে তাক্তিকভাবে নিরাময়যোগ্য। কিন্তু বেশ খারাপ
ধরনের রিস্ক থাকার কারনে পেনক্রিয়াস ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের ইন্ডিকেসনটা
এখনো পর্যন্ত খুবই সীমিত এবং বাংলাদেশের মতো দেশে সুযোগটা আরও সীমিত।
> টাইপ-২ ডায়বেটিস যেটা কিনা পেনক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন কমে যাওয়ার সাথে
সাথে শরীরের ইনসুলিনের ব্যবহারের প্রতি রেজিস্টেন্স জন্ম নেয়, সেটি এখন
পর্যন্ত অনিরাময়যোগ্য। খুব অল্প রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে একবার টাইপ-২
ডায়বেটিস হওয়ার পরে রোগটা অনেকটা রিমিসনে যেতে পারে। এখানে রিমিসন মানে কি?
এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় এইভাবে, রোগের সাইন সিম্পটম নাই, ব্লাড গ্লুকোজ
পরীক্ষার রেজাল্টও স্বাভাবিক, মেডিসিন বা লাইফস্টাইল মডিফিকেসন যেমন
ব্যায়াম বা ওজন কমানো ছাড়াই ব্লাড সুগার নরমাল থাকা। কিন্তু এরকম ঘটনা অতীব
বিরল এবং এখনো প্রশ্নের সম্মুখীন। বেশীরভাগক্ষেত্রে যা হয়, সেটা হল রোগীর
ডায়বেটিসের লক্ষন এবং ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রনে থাকে হয় মেডিসিনের জন্য, না হয়
লাইফস্টাইল মডিফিকেসন যেমন খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম বা ওজন কমানোর
জন্য। এতে রোগীর একটা ধারনা হতে পারে রোগী ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে সেটা
কখনোই হয় না। এক্ষেত্রে রোগী যদি আবার অনিয়ন্ত্রিত জীবনে আবার ফিরে যায়,
তবে আবার ডায়বেটিসের লক্ষণগুলো ফিরে আসে, রোগীর মনে একটা ধারনা হয়, রোগী
একবার ভালো হয়ে গিয়ে আবার নতুন করে ডায়বেটিস হয়েছে।
>> রিপোর্টেতো ডায়বেটিস নাই ডাক্তারসাহেব, তারপরেও ডায়বেটিসের ঔষধ দিলো কেন?
> রোগীর লক্ষন (ঘনঘন পানির পিপাশা পাওয়া, বারবার প্রস্রাব হওয়া, ওজন
কমে যাওয়া সহ আরও বেশকিছু) দেখে ডায়বেটিস মনে হলে প্রথম পরীক্ষাটাই হবে
OGTT (ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট)। এটা ডায়বেটিস রোগীর জীবনে একবারই হবে
এবং সে ডায়বেটিক কিনা সেটা এই পরীক্ষা থেকে জানা যাবে। এরপর থেকে রোগীর
চেক-আপে আসলে যে পরীক্ষা করা হবে সেটা হল, Fasting & 2 hours after
Breakfast ব্লাড সুগার লেভেল। এই পরীক্ষার রিপোর্ট নরমাল আসতেই পারে! কারন
পেসেন্ট একবার ডায়বেটিক বলে ধরা পড়ার পরে সে খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণ,
মেডিকেসন আর ব্যায়াম সহ জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে
রাখলে পরীক্ষায় ব্লাড সুগার নন-ডায়বেটিক লেভেলে থাকবেই। দুঃখের বিষয় হল
অনেকে, এমনকি ডাক্তাররাও OGTT আর Fasting & 2 hours after Breakfast
ব্লাড সুগার এই দুই পরীক্ষার পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে। দুটোর ইন্ডিকেসন আর
ইন্টারপ্রিটেসন পুরোই ভিন্ন। একবার ধরা পড়া ডায়বেটিক রোগীর Fasting & 2
hours after Breakfast ব্লাড সুগার দেখে যদি যদি তাকে নন-ডায়বেটিক ভাবেন
তো শুধু ভুলই হবে।
> আরেকটা ব্যাপার হল অনেক রোগী Fasting &
2 hours after Breakfast ব্লাড সুগার করার আগে তার চলমান প্রেস্ক্রিপ্সনের
মেডিকেসন ইনসুলিন/ওরাল ড্রাগ না নিয়েই রক্ত দিয়ে পরীক্ষা করে। এতে ভুল
রিপোর্ট আসবে, কারন ঐদিন তার রক্তে সুগার বেশী থাকবে। এতে বর্তমানে চলমান
মেডিসিনগুলো কতোটুকু কার্যকর সেটা বুঝতে বিশাল সমস্যা হবে। এমনকি ডাক্তার
ভুল করে ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে রোগীর হাইপোগ্লাইসেমিয়া করিয়ে দিতে পারেন। তাই
রোগীর ফলো-আপের আগেই জিজ্ঞেস করে নিন আজকের দিনের মেডিসিন সে খেয়ে এসেছে কি
না।
>> রিপোর্টে তো ডায়বেটিস নাই ডাক্তারসাহেব, তারপরেও ডায়বেটিসের ঔষধ দিলো কেন?
> এই ব্যাপারটা অনেকটা বিতর্কিত। মেটফরমিন নামের ডায়বেটিক ড্রাগ
অনেকসময় নন-ডায়বেটিক দের প্রেসক্রাইব করা হয়। এর পিছনে কিছু যুক্তি থাকে,
যেমন পেসেন্ট মোটাসোটা অথবা OGTT করে পাওয়া প্রি-ডায়বেটিক স্টেটে (Impaired
Fasting Glucose or Impaired Glucose Tolerance) থাকা রোগীদের লাইফস্টাইল
মডিফিকেসনের সাথেসাথে অনেক সময় মেটফরমিন প্রেস্ক্রাইব করা হয় যাতে ভবিষ্যতে
ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যায় বা ডিলে করা যায়। মেটফরমিনের সাথে অন্যান্য
ডায়বেটিক মেডিকেসনের পার্থক্য হল যে এটা দেহের সেলে ইনসুলিনের গ্রহনযোগ্যতা
বাড়ায় সেলের ইনসুলিন রিসেপ্টরের দুর্বলতা কমিয়ে দিয়ে। কিন্তু নরমাল
এন্টিডায়বেটিক মেডিকেসনের মতো ব্লাডসুগার কমায় না। তাই চিকিৎসাপত্রে
মেটফরমিন থাকা মানেই ডায়বেটিস আছে কি না, অথবা নিজে দিলে কেন দিলেন সেটা
রোগীকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ।
>> ইনসুলিনের বদলে মুখে খাবার ঔষধ দেন তো স্যার, ইনসুলিন নিতে ভালো লাগে না।
> সব রোগীর নিয়মিত কমপ্লেন বা ডিমান্ড হল সিরিঞ্জের বদলে মুখে খাবার
মেডিসিন দেয়া। আপাতদৃষ্টিতে মুখে খাবার ড্রাগগুলো কিছুই করে না, “একটা রসকস
বিহীন লেবুর মতো মৃতপ্রায় পেনক্রিয়াস কে চাবুক চালিয়ে কিছু ইনসুলিন বের
করার চেষ্টা চালায়।” একসময় পেনক্রিয়াস ক্লান্ত ঘোড়ার মতোই প্রান হারায়। তখন
শেষ পর্যন্ত মুখে খাবার ড্রাগ থেকে ঠিকই ইনসুলিনেই কনভার্ট করতে হয়। তাই
ডায়বেটিস যে লেভেলই থাক না কেন, সবথেকে ভালো ড্রাগ হল ইনসুলিন। রোগীকে
কনভিন্স করাটাই শুধু ডাক্তারের ক্রেডিট। তাছাড়া দেহের ইনসুলিনের সাথে
বাজারের ইনসুলিনগুলোর মিল থাকার কারনে সাইড এফেক্ট মুখে খাবার ড্রাগ গুলো
থেকে অনেক কম এবং ৫/১০ বছর পরে ডায়বেটিসের কমপ্লিকেসন হবার ঝুকিও কমে যায়
অনেকখানি ইনসুলিনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে।
>> ডাক্তারসাহেব, আমার ওজনতো এতো বেশী না। তাহলে ডায়বেটিস কিভাবে হল?
> ওজন বেশী থাকাটা ডায়বেটিসের একটা রিস্ক ফ্যাক্টর। একমাত্র
রিস্কফ্যাক্টর না। এরপরেও বুঝানোর পরেও অনেকে মানতে চায় না যে শরীরের
অবসিটি না থাকলেও ডায়বেটিক হওয়া সম্ভব।
এরকম প্রতিদিন অসংখ্য
প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে প্রতিদিনই নিজেরই নতুন অনেককিছু শেখা হয়ে যায়। ফাস্ট
প্রফে সিলেবাসে গাইটনের ডায়বেটিস আর দ্বিতীয় প্রফে ফার্মাকোলজির
এন্টি-ডায়বেটিক মেডিকেসন চ্যাপ্টার পড়ে মনেই হতো, এটাতো কতোই সোজা। এখন
দিনদিন অজ্ঞতার পরিমান আবিষ্কার করে শুধুই মনে হচ্ছে, দিনকে দিন শুধু
মূর্খই হচ্ছি। অনেক লম্বা আর বোরিং লেকচার হয়ে গেলো। প্রত্যেক পরিবারেই
কারো না কারো এই রোগের সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। সেই কথা চিন্তা করেই লিখা।
কারো কৌতূহল কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারলে খুশী হবো।।