প্রফেসনাল এক্সামঃ নতুনে করে পুরনো দিনের কথা

প্রথম প্রফঃ ২০০৯ এর জুলাই মাস, হোস্টেলে থমথমে অবস্থা। কয়েকদিন হল সরকার বদলের। সবার মাঝে চাপা অস্থিরতা। তখন ২১১ নম্বর রুমের বাসিন্দা। পাঁচ রুমমেট আমরা, একেকজন একেক প্রজাতির। তিনজন জানপ্রান দিয়ে পড়ছে। আমি আর হিমেল দুইজন একেতো ফাকিবাজ, তার উপর মনমেজাজ খারাপ, হয় মোবাইলে টিপাটিপি করে বেড়াই, না হয় গল্পবইের দুনিয়াতে ব্যস্ত। সত্যিকথা বলতে ফাস্ট প্রফের আগে যত তিনগোয়েন্দা আর মাসুদরানা পড়া হল, ৫ বছরের মেডিকেলে তার অর্ধেকও পড়া হয়ে উঠেনি। বেশী মানুষ এক সাথে বেশীক্ষণ থাকলে ঝামেলা বাড়ে, প্রফের আগেতো মেজাজ এমনিতেই সবার চড়া, অনেক ঝামেলা অনেক কষ্টের প্রতিটা রাত। এক্সামের ঠিক আগের দিনে কতোগুলো উড়ু সাজেসান আসতো, তবে যার রটে তার কিছুতো বটে। এসব পড়তে গিয়ে অনেকের আগেরদিন রাতের ঘুমটা হারাম হয়ে যেত। তারপরেও খাতায় ছাইপাস কিছু লিখে এসে দুপুরে হোস্টেলের কিছুটা কঠিন, কিছুটা তরল আর কিছুটা বায়বীয় খাবার খেয়ে দুপুরের শান্তির ঘুমের থেকে বড় কিছু ছিল না লাইফে। ঘুমের মাঝে তাড়া করে যেত দুঃস্বপ্নরা, ৫ মার্কের প্রশ্ন ভুল করে এসেছি, দুই মার্কের উত্তর দিয়ে ভুলে গেছি, পাস হবে তো? ৬ দিনের মহাযুদ্ধ পার হয়, ভাইভার রুটিন দিল। স্লাইড দেখা, সাজেসান, কোন এক্সটারনাল আসবে এসব নিয়ে কতো জল্পনা কল্পনা। এনাটমির সফটপার্ট মোটেই সফট না, আমাদের রহিম স্যারের কথাই কানে বাজত বারবার, “দেখবা তোমাদের কিছু ফ্রেন্ডরা পাস করে গেছে, আর কিছু ফ্রেন্ডরা এখনো *** এর ভিসেরা হাতে নিয়ে বসে আছে”। আর হার্ড পার্টে স্লাইড দেখতে মাইক্রোস্কোপের লেন্সের ভিতর দিয়ে তাকানোর বদলে ম্যাক্রোসকপিক ফাইনডিঙ্গস, স্লাইডে ছোট্ট করে লিখা নাম্বার অথবা স্লাইডের আকারআকৃতি দেখার জন্য বাইরে দিয়েই বেশী উঁকিঝুঁকি মারতাম। সেলিমরেজা আর পিন্টুশুভর হিস্টোলোজির কতো পেজ যে ছিঁড়ল পোলাপাইন। ভাইভা দিয়ে এসে ঝুম বৃষ্টি, পোলাপাইনের স্টেমিনার শেষ নাই। হৈচৈ করে হাফ প্যান্ট পরে মাঠে ফুটবল খেলতে গেলো, দুইতালার বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এইতো জীবন!

এরপর মাসখানেক পার, বাসায় প্রফ পরবর্তী ছুটি কাটিয়ে এর মধ্যেই ওয়ার্ড জীবন শুরু হয়ে গেছে। কোন একটা ছোট্ট ছুটিতে বাসায় যাওয়া, হটাত শুনি রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে, চিটাগাং মেডিকেলের এক মামাকে ফোন দিলে জানা যায় রেজাল্ট। হটাত মনে দুনিয়ার টেনশন, আরে বায়োকেম যে খারাপ দিসি, রেজাল্ট জেনে আর কি হবে। এদিক অদিক করতে করতে ফোন দিলামই শেষ পর্যন্ত, পাস শব্দটা কেমন শুনায় প্রতিটা ভালো খারাপ মেডিকেল স্টুডেন্টদের জীবনে ঠিক ঐ মুহূর্তেই সেটা বোঝা যায়। 





২য় প্রফঃ ২ বছরে কটকটা পাঁচটা সাবজেক্ট পড়ে জিবহার টেস্টবাডগুলো অনেক আগেই অনুভূতিশূন্য। প্রতিক্ষা কেবল “কেমনেতে এই পাঁচ বিষয়ের চক্কর থেকে বার হই”। কেউ কেউ ধরেই নিচেছে, সব সাবজেক্ট একবারে পার করা সম্ভব না, সিলেক্টিভ কিছু সাবজেক্ট ধরে তাই পড়া তাদের। যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন সূচক, ২য় প্রফের শিক্ষকদের মন বুঝে উত্তর দেয়া আসলেই অনেক কঠিন। উপরন্তু এই একটা প্রফ যখন আমরা সবাই বান্দর থাকি, বয়সের দোষ। পুরা ব্যাচ ল্যাপটপ না হয় ডেক্সটপ কিনে ফেলসে ১ম প্রফ পাস করে, হোস্টেল মোটামোটি বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্স ছিল গত ২ বছর। কি শান্তি ছিল এই ২ বছরে টের পাওয়া যায় কমিউনিটি মেডিসিন রিটেনের আগে, সত্যি কথা মেজাজি স্যারদের সহানুভূতি রিটেনে না থাকলে যুদ্ধে যাওয়ার আগেই শহীদ হয়ে যাওয়া হতো। ফার্মার ২.৩০ ঘণ্টায় ২০X৩=৬০টা প্রমান সাইজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বন্ধুদের সাথে এক্সাম হলে কথা কাঁটাকাটি করে পুরাই ফ্রাসট্রেটেড। অন্যরকম পরীক্ষা ফরেনসিক, নিজে পুরাই হুমায়ুন আহমেদ। প্যাথলজি আর মাইক্রোতে হল কিছু আদান আর কিছু প্রদানের খেলা। এরপর ভাইভা, সবাই বলে ফাইনাল প্রফের ভাইভা ভীতিকর, ২য় প্রফের কথা কেন জানি সবার স্মৃতি থেকে বাদ পড়ে যায়, হয়তো এটা এতই ইজি অথবা এতই ভীতিকর যে আমরা এটার কথা মনে করে আর কষ্ট পেতে চাই না। সবগুলো মোটামোটি ভালো মতই পার করে দিলাম, ধরা খেলাম শেষের দিন ফার্মা ভাইভা দিতে এসে। আলী স্যারের কাছে শেষ বোর্ডের শেষ পরীক্ষার্থী হিসাবে ভাইভা। শেষ ভালো যার সব ভালো তার, কথাটার সার্থকতা প্রমান করতে গিয়ে শেষটাই খারাপ করলাম। এতো খারাপ ভাইভা আমি লাইফে আর কখনো দেই নাই। স্যার হতাশ হয়ে বললেন, আচ্ছা যাও।
এরপর তো ধরেই নিলাম ২য় প্রফ আর একবারে পার হচ্ছে না। সঙ্গীসাথী অনেক, ২/৩ জন ছাড়া কেউই সব সাবজেক্ট পাসের ব্যাপারে আশাবাদী না। মাস খানেক পর রেসাল্ট দিবে দিবে, ফ্রেন্ডদের রুমে বসে আছি, এমন সময় ফ্রেন্ড রেসাল্ট নিয়ে আসলো। শুনে স্তম্ভিত, ওদের রুমের সবাই ফেল, মাত্র ৪০% এর মতো পাস। কোনভাবে ঐ ৪০% এ আমিও রয়ে গেলাম, কিন্তু ২য় প্রফের রেসাল্ট আর যাই হয়, কাউকে খুশি করে যেতে পারেনি। আপনি হয় কাঁদবেন, কিন্তু হাসবেন না। নিজে পাস করেও যে মনে কতোটা অপূর্ণতা থেকে যায়, ২য় প্রফে এসে বুঝা যায়। আলী স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম, এতো খারাপ ভাইভা দিয়েও পাস এটা ভাবতে এখনো অবাক লাগে মাঝে মাঝে।

ফাইনাল প্রফের কাহিনী আর নাই বলি, জানুয়ারির ৪/৬ ডিগ্রি টেম্পারেচারের ভোরে বরফ শীতল পানিতে ২ ঘণ্টার ঘুম থেকে জেগে হাতমুখ ধোওয়ার গল্প আর যাই হোক, এই গরমের জুলাই মাসে মানায় না।

এতোকিছু লিখার একটাই কারন, ৩ দিন পর প্রফ পরীক্ষা। এটা হতাশার গল্প না, অনুপ্রেরণার গল্পও না। এতো হতাশ হবেন না, আবার খুব বেশী খুশিও হবেন না। যে যেমন কষ্ট করে গেছেন, তার প্রতিদান অবশ্যই পাবেন।
যারা হতাশাগ্রস্ত তাদের জন্য, অনেকসময় কষ্টের পরেও কষ্টের আশানুরূপ ফল আসে না, আবার অনেকে দেখবেন প্রত্যাশার চেয়ে বেশী কিছু পেয়ে গেছে। এটা নিয়ে ভাববেন না, নিজেকে নিজের মাপকাঠিতেই শুধুমাত্র দেখবেন। আপনার সিনিয়ররা সবাই পাস করে গেছেন, আপনিও কখনো থেমে থাকবেন না। মেডিকেল লাইফটা তো শুধু এই কয়েকটা পরীক্ষা নিয়ে না।
যারা অনেক ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশী, তাঁদেরকে সবার বাইরে কিছু করতে হবে যা শুধু সময় আর ভাগ্যই বলে দিবে। আপনাকে শুধু এটা ঠিক সময়ে ঠিক ভাবে বুঝে নিতে হবে মাত্র।

সবাইকে প্রফের জন্য শুভকামনা রইল। সবার মনকামনা পূর্ণ হোক।
Share:

কোন মন্তব্য নেই:

এক নজরে...



ডাঃ লালা সৌরভ দাস

এমবিবিএস, ডিইএম (বারডেম), বিসিএস (স্বাস্থ্য)

ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং হরমোন বিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট)

সহকারী সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা

কনসালটেন্ট, ওয়েসিস হাসপাতাল, সিলেট

প্রাক্তন আবাসিক চিকিৎসক (মেডিসিন), পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মেম্বার অফ বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি

মেম্বার অফ আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিকাল এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট



Subscribe

Recommend on Google

Recent Posts