হাসপাতাল যখন বৃদ্ধাশ্রম

মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন থাকা অবস্থায় প্রায়ই কিছু রোগীকে দেখতে পেতাম যারা হাসপাতালকে ছাড়তে চাইতো না। এরা অনেক প্রকারের হতো। কেউ পারিবারিক অশান্তির শিকার, কেউ মানসিক ভাবে অবহেলিত। অল্প বয়সী কিছু মেয়েকে দেখা যেত যারা স্বামী শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করে ভর্তি হতো একগাদা মনগড়া সমস্যা নিয়ে। সব পরীক্ষানিরীক্ষার পর রিপোর্ট নরমাল হওয়ার পরেও তাদের বিশ্বাস হতো না যে তারা সুস্থ। কখনো নরম সুরে আবার কখনো কঠিন সুরে এদেরকে বিদেয় করতে হতো মাথায় চড়ে বসার আগেই।

আরেকদলে ছিল আদুরে স্বভাবের কিছু ছেলে মেয়ে, ভর্তি হতো কি সমস্যা নিয়ে সবাই ধারনা করতে পারবেন। সরকারী হাসপাতালে এদের সংখ্যা কম হলেও এদের সাথের অতি সচেতন অভিভাবকের সংখ্যা কখনো কম হতো না। হাসপাতালে এসেই এদের প্রথম দাবী হতো হাসপাতালের কেবিনে সিট নেয়া, বিদায় নেয়ার সময় শেষ কথা হতো অভিযোগ দিয়ে যে হাসপাতালের সেবার মান খুবই খারাপ। অভিভাবক রোগীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করলেই আদুরে মেয়ে বা ছেলে আরও কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে নিজের দামটা বাড়িয়ে নিতে চাইতো। 

শেষদলে থাকতো যারা, তাদেরকে বিদেয় করতেই খারাপ লাগতো সবচেয়ে। কোন বুড়ো বা বুড়ি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার সময় প্রায় সবসময়ই শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব হয় না। দিন যায়, রোগ কিছুদিন ভালো থাকে, কিছুদিন খারাপ। কিন্তু দিনের সাথে সাথে শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা কমতে থাকে। একসময় রোগীর সঙ্গী হয় তার বয়োবৃদ্ধ স্বামী/স্ত্রী অথবা অবিবাহিত মেয়েটি। হাসপাতালকেই এরা আপন করে নেয়, আসেপাশের রোগীর সাথে তাদের গড়ে উঠে এক গভীর সম্পর্ক। পারিবারিক জীবনে এরা কতোখানি একাকীত্বে ভুগে সেটা ফুটে উঠে এদের হাতে ছুটির কাগজ ধরিয়ে দিতে গেলে বলতে দেখে, “আর দুইটা দিন থেকে গেলে ভালো হয় না বাবা?”




সরকারী হাসপাতালে সিট স্বল্পতা থাকায় এদেরকে অনেকটা জোর করেই বিদায় জানাতে হতো। বেসরকারীতে এই নিয়মের বাইরে পা ফেলতে হয় অনিচ্ছাসত্ত্বেও। “আমাগো পোলায় টাকা দিব, আপনাগো হাসপাতালে রইলে সমস্যা কিতা?” এই প্রশ্নের জবাবে চুপ হয়ে যেতে হয় অনেক সময়। পোলায় কেন টাকা দিয়ে রাখতে চায় হাসপাতালে, সেটা ডাক্তারও বুঝে রোগী বা তার একান্ত সঙ্গীও বুঝে। তবুও বুঝেও এই না বুঝার ভান করে চলা। একজন বৃদ্ধ অসুস্থ রোগীকে বাসায় রেখে তার সেবায় যে কষ্ট, তার থেকে আধুনিক মানুষগুলো বোধহয় চায় রোগী হাসপাতালেই পড়ে থাকুক। বৃদ্ধের সঙ্গী তার জীবনসঙ্গী বৃদ্ধা, দুজনে মিলে হাসপাতালটাকেই নতুন ঘর করে নেয় তখন। এখানেই খাওয়া দাওয়া, এখানেই গল্পগুজব। নতুন কোন রোগী ভর্তি হলে বৃদ্ধা ছুটে যান তার সাথে পরিচিত হতে। নতুন মুখগুলোর সাথে একটু পরিচিত হওয়া, এটাই তার জীবনের একমাত্র আনন্দ।


ছুটির কাগজ লিখেতে লিখেতে বিলের পাতার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি মাঝেমাঝে। দুই/তিন লাখ টাকা বিল! পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, রোগী থেকে গেছেন ছয়মাস হাসপাতালে। ছয়মাসের রোগীর বাসার মানুষের শান্তির ঘুমের মূল্য মাত্র তিন লাখ, খুব একটা বেশী না। হাসপাতালগুলোই বুঝি এই যুগের মানুষের জন্য নতুন বৃদ্ধাশ্রম।
Share:

কোন মন্তব্য নেই:

এক নজরে...



ডাঃ লালা সৌরভ দাস

এমবিবিএস, ডিইএম (বারডেম), বিসিএস (স্বাস্থ্য)

ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং হরমোন বিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট)

সহকারী সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা

কনসালটেন্ট, ওয়েসিস হাসপাতাল, সিলেট

প্রাক্তন আবাসিক চিকিৎসক (মেডিসিন), পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মেম্বার অফ বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি

মেম্বার অফ আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিকাল এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট



Subscribe

Recommend on Google

Recent Posts